- সতীশ বিশ্বাস
ছড়াক্কাগাথা - গুহকসখা
গুহকসখা
গঙ্গাস্নানে চলেছেন রাজা দশরথ
সঙ্গে তাঁর চারপুত্র
বয়সে যদিও ক্ষুদ্র।
পুণ্যলোভে নয়; লক্ষ্যঃ
প্রকৃতির সাথে সখ্য;
হঠাৎ নারদমুনি আগলান পথ।
#
মুনি তাঁকে প্রশ্ন করে, ‘চলেছ কোথায়?’
রাজা বলে খুশি প্রাণে,
‘বেরিয়েছি গঙ্গাস্নানে।’
মুনি বলে, ‘এ কী কথা!
এ যে ঘোর অজ্ঞানতা।
জানো না কি, পুন্যপ্রাপ্তি-রামের কৃপায়!
#
দেখলে রামের মুখ গঙ্গাস্নানে আর
নেই দরকার।
কতটুকু পুন্য ওই
গঙ্গার জলে?
গঙ্গার জন্মই তো রাম-পদতলে।
মনে রেখো-ভগবান পুত্রটি তোমার।’
#
ঘাবড়ে গিয়ে দশরথ ফিরতে চায় বাড়ি।
রাম বলে, ‘বাবা,শোন,
নেই এর মূল্য কোন।
মা-গঙ্গার মহিমা কী,
মুনিবর জানে তা কি?
আর দ্বিধা নয়, চলো স্নানে তাড়াতাড়ি।’
#
পুত্রের কথা শুনে পিতা খুশি হন।
হাঁটেন গঙ্গার দিকে--
হঠাৎ সে পথটিকে
ঘিরে ফেলে উত্তাল
গুহক সে চন্ডাল;
আর শত কোটি চন্ডাল সৈন্যগন।
#
গুহক বলেন, ‘রাজা, আছে অভিযোগ।
যখনই এ পথ দিয়ে
ফিরে যান সৈন্য নিয়ে
হয়ে ভারসাম্যহারা
ক্ষয় ক্ষতি করে তারা।
ভুগতে হয় বিনাদোষে দারুণ দুর্ভোগ।’
#
রাজা বলে, ‘বন্ধ করো ক্ষোভবর্ষণ।
যেতে দাও গঙ্গাস্নানে
বড়ই আগ্রহ প্রাণে।’
গুহক তখন বলে,
‘গঙ্গাস্নানে যেতে হলে-
আমাকে করাও আগে শ্রীরামদর্শন।’
#
বলেই গুহক জোরে ‘রাম’ ‘রাম’ ডাকে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রাজা
ভাবে –এ কেমন সাজা!
এমন স্নিগ্ধ প্রাতে-
পড়লাম এ কার হাতে!
রামকে রথের মধ্যে ঢেকেঢুকে রাখে।
#
ধনুর্বান হাতে নিয়ে রাজা ভাবে মনে,
চন্ডালকে যদি মারি,
হবে তাতে নিন্দে ভারী
আর যদি কোন ফেরে
যুদ্ধে আমি যাই হেরে
অপযশ রটে যাবে বিশ্বভুবনে।
#
কিন্তু ছাড়ে না পথ গুহক বর্বর
দারুণ নাছোরবান্দা
সাথে আছে অন্য ধান্দা।
মনে মনে ভেবে রাজা,
গুহককে দিতে সাজা-
ধনুকেতে জুড়লেন ‘পাশুপত শর’।
#
শন্-শন্-চোখের নিমেষে তির গিয়ে
বাঁধে তার হাত গলা,
থামায় তার কথা বলা।
কিন্তু তখনও ক্রুদ্ধ
গুহক চালায় যুদ্ধ--
ধনুকে ছুঁড়তে থাকে তির দু-পা দিয়ে!
#
বিস্মিত ভরত গিয়ে রামকে তা বলে।
শুনে সে অদ্ভুত কথা
রাম ছুটে যায় তথা;
কৌতূহলে কিছুক্ষণ
দেখে সে নিপুণ রণ!
ভাবতে থাকে-এই বিদ্যা শিখব কী কৌশলে!
#
গুহক দেখতে পেল সামনে শ্রীরাম।
উল্লসিত হল প্রাণ,
ছেড়ে দিয়ে ধনুর্বান--
মেটাতে মনের সাধ,
পেতে তাঁর আশীর্বাদ,
গুহক রামকে করে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম।
#
গুহকের চোখে এল ভাবাবেগে জল।
রাম তার ভক্তি দেখে
তুলে তাকে মাটি থেকে
বলে, ‘সুখী হও; তবে
আমাকে শেখাতে হবে
পায়ে তীরধনু চালাবার কৌশল।
গুহক তখন গতজন্মের কথা
বলে শ্রীরামের কাছে,
শ্রীরামকে দিতে সূত্র।
গুহক সে জন্মেছিল
হয়ে বশিষ্টের পুত্র
বামদেব; ছিল বড্ড কম অভিজ্ঞতা।
#
অন্ধক মুনির পুত্র সিন্ধুকে একদিন
হরিণশিকারে গিয়ে
দশরথ বান দিয়ে
বিদ্ধ করে তার দেহ!
জানলো না আর কেহ
কোলে তুলে আনে রাজা দেহ-প্রাণহীন।
#
পাপ থেকে মুক্তি দিতে বামদেব তখন
নেহাত অজ্ঞতাবশে
রাজার নিকটে গিয়ে
রাজার কানের কাছে
মুখটি নামিয়ে নিয়ে
তিনবার রামনাম করে উচ্চারণ।
#
এক কোটি ব্রক্ষ্মহত্যা ঘোচে একবারে
সেখানে এ অর্বাচীন
একের বদলে তিন!
এ তো রীতিমত পাপ,
বাবা দেন অভিশাপ-
পরজন্মে চন্ডাল হবি রে সংসারে!’
#
বাবার পা ধরে ছেলে করে ক্রন্দন
বলে, ‘যা শাস্তি দিলে
নেব আমি মাথা পেতে
যদি পাপ দূরে যায়।
তবে মুক্তির উপায়
অনুগ্রহ করে পিতা করুন বর্ণন।
#
বশিষ্ট মুনির মনে বাৎসল্য জাগে
বলে, ‘কোনদিন যদি
শ্রীরাম করুণানিধি
দেখা দেন কৃপা করে,
একমাত্র সে প্রহরে
অভিশাপ শেষ হবে। মুক্তি নেই আগে।
#
পেয়েছি তোমার দেখা আজ ভাগ্যগুণে
প্রতিদিন রামনাম
মনে মনে জপতাম
কেঁদে কেঁদে ভাবতাম-
কবে দেখা পাবো রাম!’
রামের গলল প্রাণ বৃত্তান্ত শুনে।
#
বাবার নিকটে গিয়ে নম্র করপুটে
বলে ধীরে রঘুপতি
‘দাও বাবা অনুমতি।’
রাজা বলে, তাই হোক;
নাম করো ‘সার্থক
পতিত জমিতে যাতে নানা ফুল ফোটে।
#
রাম নিজে গুহকের বাঁধন খুললেন।
লক্ষ্মণকে বলে, ‘ভাই,
তোমার সাহায্য চাই।
আয়োজন করো সব,
এও এক উৎসব।’
লক্ষ্মণ হাসিমুখে তাই করলেন।
#
স্বর্গের দেবতারা দেখে স্বর্গ থেকে-
ব্রাক্ষ্মণ চন্ডালকে বুকে
জড়ালো পরম সুখে!
জুড়ালো তাদের চোখ,
ভাবলো-এমনই হোক।
দুজনের বন্ধুত্ব হল অগ্নিসাক্ষী রেখে।
#
রাম বলে, ‘বন্ধু থাকো;এই আমি চাই।
যেই তুমি, সেই আমি;
বন্ধুতা সর্বত্রগামী।
নানা ভাষা-এক কথা।
অভিন্ন মানবিকতা।
ব্রাক্ষ্মণ ও চন্ডালেতে কোন ভেদ নাই।
#
ভালো কথা; তবে সবিনয়ে জানতে চাই-
সত্যিকথা বলো রাম
ব্রাক্ষ্মণ হয়েও তুমি
চন্ডালের হস্ত চুমি
পুরালে তার মনস্কাম।
কেন? এর পিছনে কি কোন ফন্দি নাই?
#
একি শুদ্ধ জীবে প্রেম? নাকি কোন ছল?
যখনই শুনেছ তুমি
ভরতের মুখ থেকে
এ চন্ডাল পায়ে তির
ছোঁড়ে; ও লক্ষ্যে স্থির।
তখনই এ বিদ্যা শিখতে আঁটো নি কৌশল?
#
বলো রাম, স্পষ্ট করে, রেখো না কুহক,
না থাকতো যদি এই
চন্ডালের এ দক্ষতা,
কিম্বা তোমারও যদি
থাকতো এ যোগ্যতা--
বন্ধুর সম্মান পেত কি গুহক?
#
সেই সাথে তুমি বলো,রাজা দশরথ।
হঠাৎ আজব সুরে
অ্যাক্শো আশি ডিগ্রী ঘুরে
কেন দিলে অনুমতি
বন্ধু করে নিতে তাকে--
যাকে মারতে ছুঁড়েছিলে শর ‘পাশুপত’?
#
তুমিও কি বুঝেছিলে রামের মতলব ?
যা হোক, এ সংশয়
দূর করো দয়াময়।
ভন্ডামির হোক ক্ষয়
সত্যের হোক জয়।
একি! কেন দুই জনে তোমরা নীরব?
